সেই দিনটা ছিল 2.6.2023। দক্ষিণ এশিয়ার বা ভারতবর্ষের ইতিহাসে সব থেকে বড় ট্রেন দুর্ঘটনা। একসাথে তিনটি ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। দুইটি ট্রেন ছিল যাত্রীবাহী ট্রেন (HWH Humsafar Express, Coromandel Express) এবং একটি ছিল মালবাহী ট্রেন বা মাল গাড়ি। কলকাতার শালিমার জংশন স্টেশন থেকে বিকেল 4:50 চেন্নাই সেন্ট্রাল গন্তব্যে রওনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল সেই করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনটা। শালিমার স্টেশন থেকে বেরোনোর সময় ১-২ মিনিট মতো লেট ছিল ট্রেনটা। শালিমার জংশন থেকে বেরিয়ে খুব কাছেই এবং কলকাতার মধ্যেছিল সাতরাগাছি জংশন, তারপরের স্টপেজ ছিল খড়গপুর জংশন, এই খড়গপুর জংশন থেকে বেরিয়ে চলে গেল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাইরে। পরের স্টপেজ স্টেশন ছিল উড়িষ্যার স্টেশন "বালাসোর"।
আর সেই বালাসোর স্টেশনের পরের স্টপেজ উড়িষ্যার "ভদ্রক" স্টেশন।
এবং ভদ্রক স্টেশন পৌঁছাতেই ঘটে গেল এই ভারতবর্ষের সবথেকে বড় ট্রেন দুর্ঘটনা,
বালাসোর স্টেশন থেকে "করমন্ডল এক্সপ্রেস" এর আর উড়িষ্যার ভদ্রক স্টেশন পৌঁছানো হলো না। উড়িষ্যার বালাসোর স্টেশন থেকে বেরিয়ে মাত্র তিনটি সাব স্টেশন পার করে "বাহানাগা বাজার" সাব স্টেশনের সামনে ঘটে গেল সেই দুর্ঘটনা। হাজার হাজার যাত্রীদের যাত্রাটা শুভ আর হলো না।
আবার অন্যদিকে "SMVT বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়া" হামসাফার এক্সপ্রেস তার 90 শতাংশ যাত্রা শেষ করে ভালোভাবেই অতিক্রম করেছিল ভদ্রক স্টেশন। হামসাফার এক্সপ্রেসের পরের স্টপেজ ছিল বালাসোর, কিন্তু বালাসোর পৌছাতে মাঝখানে আরো দশটা সাব স্টেশন দ্রুত পাড়ি দিতে হতো হামসাফার এক্সপ্রেস কে। ঠিক তেমনি করমন্ডল এক্সপ্রেসকেও বালাসোর স্টেশন থেকে ভদ্রাক পৌঁছাতে দশটা সাব স্টেশন পাড়ি দিতে হতো করমন্ডল এক্সপ্রেস কে।
যেহেতু দুটো ট্রেনই পশ্চিমবাংলা থেকে যাওয়া আসা করছিল তাই বেশিরভাগই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ছিলেন। আবার অনেকে বাংলাদেশী ও ছিলেন। তারা কেউ কর্মসূত্রে আর কেউ চিকিৎসার জন্য আবার কেউ টুরিস্ট হিসাবে যাচ্ছিল।
তখন সময়টা ছিল সন্ধ্যা 6:50। বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়া যাওয়ার "হামসাফার এক্সপ্রেস" ট্রেন টা উড়িষ্যার ভদ্রক স্টেশন থেকে ছেড়ে বালাসোর স্টেশন পৌঁছাবার জন্য রওনা দিলো। ভদ্রক থেকে বালাসোর পৌছাতে মাঝখানে দশখানা "সাব স্টেশন" পড়ে যেমন ( Bhadrak, Ranital Link junction cabin, Ranital, Markona, Sabira, Soro, Bahanaga Bazar, Panpana PH, Khantapara, Nilgiri Road, Balasore )। ভদ্রক স্টেশন থেকে ছয় নম্বর সাব স্টেশন এবং বালাসোর থেকে চার নম্বর সাব স্টেশন হলো "বাহানাগা বাজার"। এই স্টেশনের সামনেই রেল লাইনে একটা "লুপ লাইন" ছিল। এবং সেই লুপ লাইনের মধ্যেই ছিল মালবাহী ট্রেনটি। ( loop line হল সেই জায়গা, যে জায়গা থেকে ট্রেন ইউ ট্রান করে। বা মেন লাইনে কোন এক্সপ্রেস ট্রেন থাকলে সেই এক্সপ্রেস ট্রেনগুলিকে যাওয়ার জন্য জায়গা করে দেওয়া হয় এই loop লাইনের মধ্যে, মেন লাইনে থাকা অন্য ট্রেন ঢুকিয়ে। ) করমন্ডল এক্সপ্রেস কে জায়গা করে দাঁড়িয়েছিল এই মালবাহী ট্রেনটি।
সেই করমন্ডল এক্সপ্রেস বালাসোর জংশন থেকে বেরিয়ে সর্বোচ্চ গতি নিয়ে ছোটে এই ট্রেনটা। দশটা সাব স্টেশন পর ভদ্রাক স্টেশন পৌছাবার কথা। যেহেতু করমন্ডল এক্সপ্রেস মাঝখানে সিগনাল না পেয়ে তিন থেকে পাঁচ মিনিট লেটে চলছিল। তাই সেই সময়টাকে মেকআপ করার জন্য সর্বোচ্চ গতিতে ছোটে করমন্ডল এক্সপ্রেস।
"বালাসোর" স্টেশন থেকে বেরিয়ে নীলগিরি রোড, খান্তাপাড়া, পানপানা সাব স্টেশন গুলি পেরিয়ে যখন "বাহানাগা বাজার" স্টেশনটি অতিক্রম করতে যাচ্ছিল তখন "করমন্ডল এক্সপ্রেস" এর গতি ছিল 130 কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়।
"বাহানাগা বাজার" স্টেশনটির সামনেই ছিল সেই লুপ লাইনটি, আর সেই লুপ লাইনের মধ্যে ঢুকে ছিল মালবাহ ট্রেনটি।
"হামসাফার এক্সপ্রেস" জোরে করে হর্ন দিয়ে বাহানাগা বাজার স্টেশন টি পার করে 127 কিলোমিটার গতিতে। ঠিক তারপরেই!
কি থেকে কি হয়ে গেল 2.6.2023 সন্ধ্যা 6:50 নাগাদ ঘটে গেলো ভারতের ইতিহাসে সবথেকে বড়ো রেল দুর্ঘটনা।
"করমন্ডল এক্সপ্রেস" টি তার সর্বোচ্চ গতিতে ধাক্কা দেয় লুপ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মালবাহী ট্রেনের পিছনে।
সেই ধাক্কা লাগার তীব্রতা এতটাই ছিল যে করমন্ডল এক্সপ্রেস এর লোকোমোটিব খেলনা গাড়ির মতো পুরোটা মালবাহী গাড়িটির পেছনের বগিতে উঠে যায়। করমন্ডল এক্সপ্রেস এর প্রথম যাত্রীবাহী কামরাটা তার সর্বোচ্চ গতিতে গিয়ে ধাক্কা মারে মাল গাড়িটির পিছনে এবং দুমড়ে মুছরে যায় করমন্ডল এক্সপ্রেস এর প্রথম কামরাটি। তার পরপর তিনটি কামরা পুরো উল্টে যায় আর প্রায় সব কটি কামরাই লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে, পাশ দিয়ে সর্বোচ্চ গতিতে বেরিয়ে যাওয়া সেই হামসাফার এক্সপ্রেস এর লাস্ট তিনটি যাত্রীবাহী কামরা য় করমন্ডল এক্সপ্রেস এর কামরাগুলি ধাক্কা মারে। এবং হামসাফার এক্সপ্রেস এর সেই লাস্ট তিনটি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে উল্টে পড়ে যায়।
সেই দুর্ঘটনার তীব্রতা এতটাই ছিল যে কোন কামরাটা কোন ট্রেনের এবং পর কোন কামরার পর কোন কামরা ছিল সেটা বোঝা মুশকিল। করমন্ডলের তিন নম্বর কামরা একদম সামনে চলে গেছে আর দ্বিতীয় কামরাটা উল্টে অন্যদিকে পড়ে আছে। যেন মনে হচ্ছে কোন বাচ্চা তার খেলনা গাড়ি গুলো উল্টে পাল্টে এদিক-ওদিক ফেলে রেখেছে।
সর্বোচ্চ গতিতে ছুটতে থাকা করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনটি হঠাৎ করে বিকট শব্দের সাথে একটা ঝাঁকুনি তারপরেই অনেকেই জ্ঞান হারায়। ১৩০ কিলোমিটার স্পিড থেকে হঠাৎ করে স্পিড শূন্য হয়ে যায়। তারপরেই ছিটকে যায় মানুষ, সাথে থাকা মালপত্র, ব্যাগ, কেউ কারো গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ট্রেনের সিটগুলো ভেঙে ঢুকে যায় মানুষ, ট্রেন উল্টে গিয়ে কারো সিট মাথার মধ্যে পড়ে, কেউ দেখে আগুনের ঝলকানি, আবার কেউ অনুভব করে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে যাওয়ার সেই ঝাকুনি।
সঙ্গে সঙ্গে বাহানাগা বাজারের আশেপাশে থাকা কিছু বাসিন্দা ছুটে যায় সাহায্য করতে। সেখানে গিয়ে এমন অবস্থা দেখে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।
প্রথমত ওখানে ছিল অন্ধকার, তার মধ্যে কান্না-আর্তনাদ ও চিৎকার চেঁচামেচি চারিদিকে, সে যেন এক নরকীয় অবস্থা । কেউ মোবাইলের ফ্লাশ লাইট আবার কেউ কেউ টর্চ লাইট নিয়ে অনেকেই সেখানে দেখছিল কারো হাত কেটে এক জায়গায় পড়ে আছে, কারো মাথা কেটে আরেক জায়গায় পড়ে আছে, কেউ হাত পা ভেঙ্গে দুমড়ে মুছরে এক জায়গায় পড়ে আছে। কোনটা যে কার হাত-পা, কার মাথা কোথায় কেটে পড়ে আছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কেউ উল্টে যাওয়া কামড়ার মধ্যে থেকে চিৎকার করে তার স্বজনকে খুঁজছে। এদিকে আর একটা ভয় উপর থেকে ট্রেনের ২৫ হাজার ভোল্টের কারেন্ট তারগুলো না ছিড়ে পরে। যেগুলো দেখে একটা সুস্থ সবল মানুষ আঁতকে উঠবে। এতকিছুর মধ্যেও কিছু অসৎ লোক সেখানে উপস্থিত থেকে মোবাইল, টাকা পয়সা, ব্যাগ নিয়ে চম্পট দেয়। আবার অনেকে আছে তার নিজের জীবনে পরোয়া না করে অন্যের সাহায্যর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। চারিদিকে এত মৃতদেহ পড়েছিল কাকে ছেড়ে কাকে হেল্প করবে হতভম্ব হয়ে যাচ্ছিল সবাই।
২৩০-২৪০ জন মত মানুষ সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। এবং ৯০০ জনের বেশি মানুষ গুরুতরভাবে আহত হয়।
এই দুর্ঘটনা ঘটার প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে উড়িষ্যার সরকার থেকে উদ্ধারের কাজ শুরু হয়। এবং সারারাত থেকে সকাল পর্যন্ত উদ্ধারকার্য চলে। গ্যাস কাটার দিয়ে কামড়াগুলি কেটে, সেই হাত কাটা, গলাকাটা মৃতদেহ উদ্ধার হয়। এবং প্রচুর মানুষকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে সঙ্গেই কাছাকাছি সব হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। এত আহত সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে সব হসপিটালে চারিদিকে রক্তের রক্তাক্ত হয়ে গেছে। কেউ পুরো কোমায় চলে গেছে, কারো নাক মুখ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, কারো হাত-পা ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে গেছে, কেউ হসপিটালে গিয়েও মারা যাচ্ছে,
পরে সেই মৃত সংখ্যা বেড়ে চলে যায় ৩০০ জনের উপরে। আহত এর সংখ্যা হাজার এর কাছাকাছি।
(উড়িষ্যার বালেশ্বর রেল দুর্ঘটনায় মৃতদেহের স্তুপ, একই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মাল গাড়ির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ করমন্ডল এক্সপ্রেসের, মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ২৯৫, এই মানুষগুলো কি ভেবেছিল এই যাত্রাই তাদের শেষ যাত্রা? এই রেল যাত্রার ওপর তাদের সম্পূর্ণ ভরসা ছিল! তারা ঠিক পৌছবে তাদের গন্তব্যস্থলে। কিন্তু অসতর্কতার ভয়াবহ দুর্ঘটনা ছিনিয়ে নিল তাদের প্রাণ।)
কেউ এসেছিল তার কর্মস্থান থেকে মামার মৃত্যুর জন্য বাড়িতে, এবং সেই কর্ম স্থানে ফিরে যাওয়ার পথেই এমন দুর্ঘটনার কবলে পড়লো।
কত বাবা মার বুক খালি হলো ছেলেকে ভিন রাজ্যে কর্মসূত্রে পাঠিয়ে।
কারো ভালোবাসা বাড়ি ফেরা হলো না, ঠিক এমনই একটা ডায়েরী পাওয়া গেল সেই ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে।
আর সেই ডাইরিতে লেখা ছিল!
"ভালবাসা এই মন তোকে চায় সারাক্ষণ আছিস তুই মনের মাঝে, পাশে থাকিস সকাল সাঁঝে। কী করে তোকে ভুলবে এই মন, তুই যে আমার জীবন...’’
এরকম আরো অনেক স্বপ্ন, আশা, ভালবাসা। কেউ তার নিজের আপন জনকে হারিয়েছে, কেউ বাবা-মাকে, কেউ ছেলে-মেয়েকে কারো প্রেমিক প্রেমিকা। এরকম আরো কত জীবন কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ধ্বংসস্তূপের মাঝে।
যারা এই দুর্ঘটনার পরে হেল্প করতে গিয়েছিল সেখানে তাদেরকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। এবং অনেকে গুরুতর আহত অবস্থায় হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিল তাদেরকে রক্ত দান করার জন্য অনেক মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদেরকে জানাই আমার বুক ভরা ভালোবাসা। আপনাদের দেখে মনে হয় যে এখনো পৃথিবীতে মানবিকতা বেঁচে আছে।
এবং যারা এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী তাদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাই।