মেহুল তার ঘরের কোণে বসে ছিল, পড়ার টেবিলের সামনে রাখা বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তার মন ঠিকমতো বইয়ের শব্দগুলো ধরতে পারছিল না। মনটা বারবার অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল, গত কয়েকদিন ধরে সবকিছু কেমন যেন অগোছালো লাগছিল। তিতাসের সঙ্গে সম্পর্কটা আগের মতো নেই, কথাবার্তা কমে যাচ্ছে, ছোটখাটো বিষয়েও ঝগড়া লেগে যাচ্ছে। প্রেমিকের মনোযোগের অভাব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু নিজেই কি সেটাকে স্বীকার করতে পারছে?
ঠিক তখনই ঘরের দরজা ঠেলে তার মা ঢুকে এলেন। হাতে একটা পানির বোতল, মুখে মৃদু হাসি।
"কি রে মা, সারাদিন এই বইয়ের মাঝেই ডুবে থাকবি নাকি? বাইরে একটু বেড়িয়ে আয়। সারাক্ষণ মুখ গম্ভীর করে বসে থাকিস," মা মৃদু হাসির সঙ্গে বললেন।
মেহুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, "পড়াশোনা তো করতে হবেই মা। বাইরে গেলে তো আর নম্বর বাড়বে না!"
মা তার পাশে এসে বসলেন, একটু সময় চুপচাপ থাকলেন, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, "দেখ মা, তোর বয়স তো কম হলো না। পড়াশোনা তো চলবেই, কিন্তু জীবনের অন্য দিকগুলোও ভাবতে হবে, বুঝলি?"
মেহুল কিছুটা অবাক হয়ে তাকাল, "মানে? কী বলতে চাইছ?"
মা একটু হেসে বললেন, "মানে, তোর জন্য ভালো সম্বন্ধ আসছে। তুই তো জানিস, তোর বাবা আর আমি সবসময় চাই তোর ভালো হোক। যদি একটা ভালো ছেলে পাওয়া যায়, তোর কেমন লাগবে?"
এই কথা শুনেই মেহুল কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার বুকের মধ্যে যেন একটা ধাক্কা লাগল।
"মা! এত তাড়াতাড়ি এসব কথা কেন? আমার তো এখনো কেরিয়ার নিয়ে অনেক কিছু ভাবতে হবে!"
ঠিক তখনই দরজা দিয়ে বাবা ঘরে ঢুকলেন। তিনি হয়তো বাইরের ঘর থেকেই কথোপকথন শুনছিলেন। মুখ গম্ভীর ছিল, তবে চোখে ছিল কোমলতা।
মা হালকা হাসলেন, "আমি শুধু বলছিলাম যে, মেহুল তো বড় হয়ে গেছে, তার জন্য একটা ভালো সম্বন্ধ দেখা উচিত।"
বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, "মেহুল, তোর মা ভুল কিছু বলেনি। আমরা তোকে জোর করবো না। কিন্তু তুইও আমাদের কথা একটু ভাব।"
মেহুল বিরক্ত হয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, "আমি এখন বিয়ে করতে চাই না! আমার নিজের লক্ষ্য আছে, আমি কেরিয়ার নিয়ে ভাবতে চাই। মা, বাবা, প্লিজ!"
মা একটু নরম হয়ে বললেন, "তুই ভুল বুঝিস না মা। আমরা তোকে জোর করবো না, শুধু বলছি, একটু ভাব। যদি এমন কেউ থাকে, যে তোকে সত্যিই বোঝে, ভালোবাসে, তাহলে তো তোদের ভবিষ্যতও ভালো হবে, তাই না?"
বাবা মৃদু স্বরে বললেন, "আমরা জানি, তোর নিজের চিন্তাভাবনা আছে। কিন্তু জীবন শুধু একা একা কাটানোর জন্য নয়, কারো সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্যও।"
মেহুল হতাশ হয়ে বলল, "কিন্তু আমি তো এমন কাউকে পাইনি, যে আমাকে সত্যিই বোঝে!"
তার কণ্ঠে অসহায়ত্ব ছিল। হয়তো সে নিজেও জানে, তার বর্তমান সম্পর্কটা ভাঙনের পথে, কিন্তু সেটা মেনে নিতে পারছে না।
মা-বাবা আর কিছু বললেন না। তারা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, হয়তো এখন সময় হয়নি।
ঘরে নেমে এল এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। জানালার বাইরে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছিল, যেন আকাশও এক অজানা দোটানার মধ্যে পড়ে আছে।