সপ্তম অধ্যায়: প্রতীক্ষার সমুদ্র

অফিস থেকে চার দিনের ছুটি পাওয়া মাত্রই অভিষেক ও তার বন্ধুরা পুরী যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছিল। যদিও সবাই মজা করার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল, কিন্তু অভিষেকের মনে ছিল একটাই প্রশ্ন—"সে কি এখানেই আছে? যদি তাকে খুঁজে পাই?"

পুরী পৌঁছানোর পর থেকে অভিষেক যেন একটা অদৃশ্য আকর্ষণের টানে চলতে থাকে। সকালের নরম আলোয় সমুদ্রের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখ সারাক্ষণ খুঁজে বেড়ায় একটা চেনা মুখ। বন্ধুদের সঙ্গে বিচের বালিতে ফুটবল খেলে, সমুদ্রের জলে পা ভিজিয়ে হাসির মধ্যে নিজেকে রাখার চেষ্টা করলেও তার মন যেন কোথাও আটকে আছে।

ভুবনেশ্বরেও খোঁজা হয়েছে...
পুরী আসার আগে অভিষেক ভুবনেশ্বরের বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেছিল। রেল স্টেশন, কলেজের আশেপাশে, এমনকি একবার গোপনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে গিয়ে দেখেও এসেছিল। মনে মনে ভেবেছিল, হয়তো সেও কলেজে যায়, হয়তো ভাগ্য তাকে একবারের জন্য হলেও দেখা করিয়ে দেবে। কিন্তু না, কোথাও তার ছায়া নেই।

পুরীর রাস্তায় হারিয়ে যাওয়া এক স্মৃতি সমুদ্রের ধারে অসংখ্য পর্যটকের ভিড়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরোয় অভিষেক। সারাদিন ধরে জগন্নাথ মন্দির, সৈকতের আশেপাশে, হোটেলের রাস্তাগুলোতে অনেক খোঁজ করেছে। তবুও দেখা মেলেনি।

একদিন সন্ধ্যায়, বিচের ধারে বসে থাকা অবস্থায় হঠাৎ তার মনে হলো, "হয়তো আমি ভুল করছি। সে কি সত্যিই এখানে আছে? নাকি আমি শুধু আমার কল্পনায় তাকে খুঁজছি?"

তার মনে দ্বিধা তৈরি হয়। বন্ধুরা তাকে টেনে নিয়ে যেতে চায় কোনো এক ক্যাফেতে, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে সমুদ্রের দিকে। সেই সন্ধ্যার আকাশের নিচে, উড়ে যাওয়া পাখির সারিতে, বালির ওপর ছায়া ফেলে রাখা ঢেউয়ের আলোর খেলায়—সেখানে কি সত্যিই কেউ আছে?

 

অন্যদিকে, অদিতির দিনগুলো...

অদিতিও পুরীতেই আছে, কিন্তু এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতার মধ্যে। বাবার কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে সে প্রায়ই সমুদ্রের ধারে আসে। কোনোদিন একা, কোনোদিন মা আর ভাইকে নিয়ে। বাবা সবসময় অফিসের কাজে ব্যস্ত, তাই পরিবারের সবাই এখানে এলেও, তার দিনগুলো যেন একাকীত্বে মোড়া।

প্রতিদিন বিকেলে সমুদ্রের ধারে বসে থাকে সে। কখনো বালির ওপর আঙুল চালিয়ে অকারণে কিছু লিখতে চেষ্টা করে, আবার নিজেই তা মুছে ফেলে। কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব করে সে, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই।

কখনো গোধূলির আলোয় সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। কখনো মনে হয়, কারো অপেক্ষায় বসে আছে, কিন্তু কাকে? সে নিজেই জানে না।

সমুদ্রের জলে পা ডুবিয়ে এক মুহূর্তের জন্য সে চমকে ওঠে, যেন হঠাৎ অনুভব করে কেউ তাকে দেখছে, কেউ তাকে খুঁজছে। পেছনে ফিরে তাকায়, কিন্তু চারপাশে শুধুই পর্যটকদের ভিড়।

 

"এটা কি শুধুই আমার কল্পনা?" নিজের মনেই প্রশ্ন করে সে।

কখনো সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, কখনো ঢেউয়ের শব্দ শুনতে শুনতে হারিয়ে যায় ভাবনার গভীরে। তার মনে হয়, এই বিশাল সমুদ্রের ওপারে হয়তো কেউ তাকে খুঁজছে, কেউ হয়তো তার উপস্থিতির কথা অনুভব করছে। কিন্তু কে? কেন এই অনুভূতি?

মাঝে মাঝে মা আর ভাইকে নিয়ে মন্দিরেও যায়, জগন্নাথ দেবের সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে কিছু প্রার্থনা করে, কিন্তু সেই প্রার্থনার শব্দও যেন তার নিজের কাছেই অস্পষ্ট লাগে।

একদিন বিকেলে, সমুদ্রের ধারে বসে থাকার সময় হঠাৎ তার মনে হলো—"আমি কি কাউকে মিস করছি? নাকি কেউ আমাকে মিস করছে?"

সমুদ্রের গর্জনের মাঝে সে একটা উত্তর খুঁজে পেতে চায়, কিন্তু সমুদ্র শুধু ঢেউ তোলে, কোনো উত্তর দেয় না...

 


 Part 7


1 2 3 4 5 6 7
Blog Categories

My Diary

Music Related