অধ্যায় ৮: ঘণ্টার ধ্বনির মাঝে মিলন

জগন্নাথ মন্দিরের সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে। বিশাল ঘণ্টাগুলোর ধ্বনি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে, ভক্তদের কীর্তনে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠেছে। আগুনের শিখা দোল খাচ্ছে, ধূপের মিষ্টি গন্ধ মিশে আছে বাতাসে।

অভিষেক ধীরে ধীরে মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ায়। এতদিন ধরে খুঁজেও যার দেখা পায়নি, আজ বুঝি শেষবারের মতো সে নিজের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে চলেছে সবকিছু। কালই ফিরতে হবে কলকাতায়, এই শহর তার কাছে শুধুই আরেকটা অধ্যায়ের মতো রয়ে যাবে।

সে গভীর শ্বাস নেয়, ক্লান্ত চোখে একবার চারপাশ দেখে নেয়। তারপর ধীরে ধীরে হাতজোড় করে, চোখ বন্ধ করে প্রণাম জানায় জগন্নাথ দেবকে। মনে মনে বলে—

"হে জগন্নাথ, যদি তার দেখা পাওয়ার কথা থাকে, তবে একবার অন্তত দেখতে দাও!"

সে চোখ বন্ধ রেখেই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে।

ঠিক তখনই...

একটা নরম, কোমল দৃষ্টি তার দিকে স্থির হয়ে থাকে।

অদিতি!

সে ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে, দুই হাতে প্রণামের ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অভিষেকের শান্ত, নিবিষ্ট মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। এতদিনের অপেক্ষা, এতদিনের খোঁজা—আজ যেন কোনো এক অলৌকিক খেলায় এই মন্দিরের পবিত্রতায় মিলিয়ে গেল।

ঘণ্টার শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠছে, ভক্তদের কীর্তন আরও জোরে জোরে বাজছে, অথচ এই মুহূর্তে তাদের চারপাশ নিঃশব্দ হয়ে গেল।

 

অভিষেক ধীরে ধীরে চোখ খুলল।

তার দৃষ্টি প্রথমে জগন্নাথ দেবের দিকে ছিল। কিন্তু কিছু একটার অনুভূতি তাকে পাশের দিকে তাকাতে বাধ্য করল।

তার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অদিতি!

চোখে অবিশ্বাস, বিস্ময় আর গভীর অনুভূতি একসঙ্গে খেলা করছে অভিষেকের চোখে। যেন অনেকগুলো মুহূর্ত একসঙ্গে জমাট বেঁধে আছে তাদের মাঝে।

 

অদিতি ধীরে ধীরে একটা মৃদু হাসি দিলো।

"তুমি খুঁজছিলে?"

অভিষেক কিছু বলতে পারলো না। গলার কাছে যেন সমস্ত শব্দ আটকে গেছে। সে শুধু তাকিয়ে থাকলো, একটা অদ্ভুত প্রশান্তি যেন বয়ে গেল তার হৃদয়ের উপর দিয়ে।

অদিতি আর কিছু বললো না। শুধু হাতের তালু একসঙ্গে জোড় করে আবার জগন্নাথ দেবকে প্রণাম করলো।

অভিষেকের চোখের কোণে একফোঁটা জল জমে উঠল, হয়তো সেটা প্রার্থনার জল, বা হয়তো এতদিনের খোঁজার শান্তি।

সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, তাদের গল্পও একটা চূড়ান্ত মোড়ে এসে পৌঁছালো।

কিন্তু আজ আর ঢেউ হারিয়ে যাবে না। আজ ঢেউ এসে মিলবে কূলের সঙ্গে।

তবে ঠিক তখনই…

পেছন থেকে কৌশানি দাঁড়িয়ে ছিল।

কৌশানি, অভিষেকের অফিসের সহকর্মী, যে একসময় ভেবেছিল হয়তো তার সঙ্গেই অভিষেকের গল্পটা লেখা হবে। যে নিজের মনে অজান্তেই কিছু অনুভূতি তৈরি করেছিল, যা কখনো প্রকাশ করতে পারেনি।

সে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল পুরো দৃশ্যটা।

অভিষেকের মুখের সেই প্রশান্ত হাসি, চোখের সেই অপার বিস্ময়—এসব কিছুই তার চোখে ধরা পড়লো।

কৌশানি বুঝতে পারলো, তার আর কোনো জায়গা নেই এই গল্পে।

তার পায়ের নিচের মাটিটা যেন একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। বুকের মাঝে একটা শূন্যতা তৈরি হচ্ছে, একটা চাপা কষ্ট, যা সে কাউকে বলতে পারবে না।

তার চোখের কোণে জল জমে উঠলেও সে সেটা মুছে ফেললো এক মুহূর্তেই। হয়তো এই অনুভূতির কোনো দাবিই ছিল না, হয়তো এটা একতরফা কিছু ছিল, যা কখনোই বাস্তবে রূপ নেবে না।

সে আর দাঁড়ায়নি। নিঃশব্দে ঘুরে চলে গেল মন্দিরের বাইরে, ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেল, যেন কখনোই সেখানে ছিল না।

অভিষেক আর অদিতি কিছুই জানলো না।

তারা তখনো দাঁড়িয়ে, একে অপরের দিকে তাকিয়ে, ঘণ্টার ধ্বনির মাঝে তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার গল্প শেষ করে নতুন শুরুর অপেক্ষায়...

 


 Part 8


1 2 3 4 5 6 7 8
Blog Categories

My Diary

Music Related