ভুবনেশ্বর স্টেশনে ট্রেন থামতেই যেন চারপাশে ব্যস্ততার ঢেউ বয়ে গেল। ট্রেনের যাত্রীরা নামছে, কুলি হাঁকডাক করছে, অটোচালকরা যাত্রী টানার চেষ্টা করছে—সব মিলিয়ে যেন এক মুহূর্তের জন্যও স্থিরতা নেই। অদিতির পরিবারও ব্যস্ত হয়ে উঠল। বাবা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন, মা ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত, আর ভাই তো স্টেশনের দোকান থেকে চিপস-চকলেট কেনার বাহানায় ঘোরাঘুরি করছে।
এই ব্যস্ততার মাঝেও অদিতির মন যেন কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল। এতদিন ধরে ভুবনেশ্বর তার কাছে শুধুই বাবার অফিসের শহর ছিল, কিন্তু এবার মনে হচ্ছিল যেন সবকিছু নতুন লাগছে।
নতুন শহর, পুরনো অনুভূতি
গাড়িতে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকল অদিতি। শহরের রাস্তা, গাড়ির হর্ন, লাইটে ঝলমল করা দোকানপাট—সবই চেনা, অথচ আজ যেন কেমন অচেনা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এখানে আসার পরও কিছু একটা রয়ে গেছে পিছনে, কোথাও দূরে।
মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে কি একটু বেশিই ভাবছে? মাত্র কয়েক ঘণ্টার পরিচয়, এত সহজেই কি কাউকে ভুলে যাওয়া সম্ভব?
ফোনটা বের করে স্ক্রল করতে লাগল অদিতি। ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ—সব দেখে নিল, যদিও জানে অভিষেক সেখানে কোথাও নেই। তার না আছে নম্বর, না আছে কোনো যোগাযোগের মাধ্যম। এমনকি পুরো নামটাও জানা হয়নি!
"কিন্তু কিছু মানুষ কি শুধুই মুহূর্ত হয়ে আসে? তাদের কি কোনো স্থায়ী ঠিকানা হয় না?"
এই প্রশ্নটাই বারবার মনে আসছিল।
গাড়িতে বসে হালকা করে মাথা জানালায় ঠেকিয়ে রাখল সে। বাইরে সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে, আর ট্রাফিক লাইটগুলো যেন শহরের ব্যস্ততা আরও বেশি উজ্জ্বল করে তুলছে।
অভিষেকের দিনযাপন
অন্যদিকে, অভিষেকও নিজের নতুন জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। অফিসে যোগ দিয়েছে, নতুন সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, কাজের প্রেশার সামলাতে শিখে নিচ্ছে। কিন্তু মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে, বা রাতের খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, তার মনে পড়ে যায় সেই ট্রেনের সফর।
একদিন সন্ধ্যায়, সে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাহুলের সঙ্গে কফিশপে বসে ছিল।
“কী রে, কেমন চলছে?” রাহুল জিজ্ঞেস করল।
“হুম, ভালোই... তবে জানিস, কয়েকদিন আগে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে,” বলে অভিষেক একটু থামল।
রাহুল মুচকি হেসে বলল, “অদ্ভুত? মানে কি কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম?”
অভিষেক হাসল, “প্রেম না, তবে... ট্রেনে একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। অদ্ভুতভাবে সংযোগটা অনুভব করেছিলাম। জানিস, কারও সঙ্গে মাত্র কয়েক ঘণ্টা কাটিয়েও মনে হয়, যেন অনেক দিনের চেনা?”
রাহুল এবার একটু মন দিয়ে শুনতে শুরু করল। “ওহ! তারপর? কথা বললি? নম্বর নিলি?”
অভিষেক একটু দম নিল। “এই তো সমস্যা! কথা হয়েছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে মনে হলো, কিছু যেন বলতে পারলাম না। নম্বর নেওয়া হয়নি, এমনকি পুরো নামও জানা হয়নি! এখন মনে হচ্ছে, ওর সঙ্গে হয়তো আর কখনো দেখা হবে না।”
রাহুল মাথা নেড়ে বলল, “আরে দোস্ত, যা ভাগ্যে লেখা আছে, তাই হবে। যদি তোমাদের দেখা হওয়ার কথা হয়, তাহলে আবার কোনো না কোনোভাবে দেখা হবেই। আর যদি না হয়, তাহলে সেটা শুধু একটা স্মৃতি হয়ে থাকবে।”
অভিষেক একটু হেসে বলল, “ঠিক বলেছিস। কিন্তু জানিস, কিছু স্মৃতি ভুলতে চাইলে ভুলে যাওয়া যায় না। ট্রেনের সেই মুহূর্ত, জানালার পাশে বসে থাকা মেয়েটা, তার চোখের সেই অদ্ভুত চাহনি—সব এখনও মনে আছে।”
রাহুল মজা করে বলল, “তাহলে খুঁজে বের কর! আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই পাওয়া যায়।”
অভিষেক হাসল, “প্রোফাইলের ছবিতে শুধু ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকানো একটা মুখ থাকলে খুঁজে বের করব কেমন করে?”
রাহুল একটু চিন্তা করে বলল, “তাহলে হয়তো এই মেয়েটা শুধুই এক ট্রেন সফরের গল্প হয়ে থাকবে। কিন্তু দোস্ত, এই ধরনের সংযোগ খুব কম হয়। এটাকে সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত ছিল। তুই যদি আরেকটু সাহস করতি, তাহলে হয়তো ওকে আজ খুঁজতে হতো না।”
অভিষেক চুপচাপ কফির কাপ হাতে নিল। কথাটা সত্যি। সত্যিই কি ও সাহস করে কিছু বলতে পারত?
ম্লান হতে থাকা স্মৃতি, তবু এক ছায়া রয়ে যায়
অদিতি আর অভিষেক, দুজনেই নিজেদের জীবনে ব্যস্ত হয়ে উঠছিল। সময় গড়াচ্ছিল, আর সেই ট্রেন সফরের স্মৃতিগুলোও ধীরে ধীরে অতীতের গভীরে হারিয়ে যেতে শুরু করছিল।
তবুও, কিছু মুহূর্ত মনের মধ্যে রয়ে যায়। হয়তো অনেকদিন পর, অদিতি কোনো এক শীতের বিকেলে ট্রেনে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকবে, আর হঠাৎ অভিষেকের কথা মনে পড়বে।
অথবা কোনো এক রাতে অভিষেক যখন পুরনো গান শুনবে, তখন হঠাৎ মনে হবে, “এই গানটা শুনেই তো ওর সঙ্গে ট্রেনে বসে কথা বলছিলাম।”
স্মৃতি ম্লান হয়ে আসে ঠিকই, কিন্তু কিছু স্মৃতি মনের এক কোণে রয়ে যায়—একটা ছায়ার মতো, যাকে স্পর্শ করা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়।
তবে কি সত্যিই এই গল্প এখানেই শেষ? নাকি ভাগ্যের হাতে লেখা আছে নতুন কোনো অধ্যায়?