খড়গপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পর অদিতি ফিরে এসে আবার জানালার পাশের সিটে বসে পড়ল। অভিষেক চলে যাওয়ার পর যেন কিছু একটা ফাঁকা লাগছিল। ট্রেনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাবনারা অদিতির মনের ভেতরে এক অদ্ভুত নাচন শুরু করল। এত অল্প সময়ের মধ্যে একজন মানুষ কেন তার মনে এমন প্রভাব ফেলল, সেটা বোঝার চেষ্টা করছিল সে।
অদিতির পরিবার তখন নিজেদের মতো ব্যস্ত ছিল। কেউ বই পড়ছিল, কেউ মোবাইল ঘাটছিল। কিন্তু অদিতি জানালার বাইরের দৃশ্যের সঙ্গে অভিষেকের শেষ চাহনির মিল খুঁজে চলছিল। সে বারবার ভাবছিল, “শেষ মুহূর্তে তার চোখে আমি কী দেখেছিলাম? কিছু বলার ইচ্ছা ছিল? নাকি শুধু বিদায়ের নিঃশব্দ ইঙ্গিত?”
অন্যদিকে, অভিষেকের ট্রেন থেকে নামার মুহূর্তটি বারবার তার মনের পর্দায় ঘুরছিল। তার মনে হয়েছিল, এটাই হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিদায়।
অদিতির ভাবনার জগৎ
অদিতি নিজের মনের ভেতরে প্রশ্ন তুলল।
“আমি কি ভুল করলাম? এত অল্প সময়ে একজনকে এত আপন ভাবা কি ঠিক? মা যদি জেনে যান, কী বলবেন? আর বাবার রাগ—সেটা তো সহ্য করাই মুশকিল। কিন্তু আমি কী করব? তার চোখে যেন কিছু ছিল। হয়তো এক ধরনের নীরব আহ্বান।”
মেয়েটির মনের এই অস্থিরতা ট্রেনের জানালার বাইরে বয়ে যাওয়া নদী, গাছপালা, আর ছোট ছোট গ্রামগুলোকে যেন আরও জীবন্ত করে তুলেছিল। প্রকৃতি তার সঙ্গী ছিল, কিন্তু তাতে কোনো উত্তর ছিল না।
অদিতির বাবা-মা তার অস্বাভাবিক নীরবতা লক্ষ্য করলেন। তারা জানতেন, মেয়ে বড় হচ্ছে। তার চঞ্চলতা থেকে নীরবতার এই পরিবর্তন ঠিক স্বাভাবিক নয়। তার মা নরম গলায় বললেন, “কী হলো রে? চুপচাপ কেন? কোনো সমস্যা?”
অদিতি জোর করে হাসি এনে বলল, “না মা, তেমন কিছু নয়। একটু ঘুম পাচ্ছে।”
মা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন। বাবা একটা সন্দেহজনক দৃষ্টি দিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন, কিন্তু কিছু বললেন না।
অভিষেকের যাত্রাপথ
অন্যদিকে, অভিষেক ট্রেন থেকে নেমে কাজের জায়গায় যাওয়ার জন্য গাড়ির অপেক্ষায় ছিল। তবে তার মন এখনও ট্রেনের সিটে আটকে ছিল। তাকে অদ্ভুত এক অপরাধবোধ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।
“আমি কেন কথা বাড়ালাম? মেয়েটি বয়সে অনেকটাই ছোট। তার পরিবার হয়তো ভাবছে, আমি তাকে বিরক্ত করেছি। কিন্তু সত্যি বলতে, মেয়েটির সঙ্গে কথা বলা আমার জীবনের এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা ছিল। তার সরলতা, সেই চোখের চাহনি—সব যেন এক অলিখিত গল্প বলে দেয়।”
চোখে চোখে শেষ বিদায়
অদিতি নিজের সিটে বসে জানালার কাঁচে মুঠো ভর দিয়ে ট্রেনের দৃশ্য দেখতে দেখতে ভাবল, “সে যদি আরেকটু কথা বলত, যদি জানতে চাইত আমার ফোন নম্বর বা ঠিকানা। হয়তো আমি দিতাম না, কিন্তু তার সেই চেষ্টা আমার কাছে বিশেষ কিছু হয়ে থাকত।”
অভিষেকের ট্রেন থেকে নামার সময় তাদের চোখে চোখে যে বিদায়ের মুহূর্ত ঘটেছিল, সেটাই তাদের গল্পের একমাত্র সাক্ষী। অদিতি তার মনে মনে সেই মুহূর্তকে ধরে রাখতে চাইছিল। সে ভেবেছিল, “জীবনে অনেক মানুষ আসে আর চলে যায়। কিন্তু এই মানুষটা আমাকে কেন এত ভেতর থেকে ছুঁয়ে গেল?”
পরিবারের শাসন ও মেয়েটির ভাবনা
কিছুক্ষণ পর তার ছোট ভাই মজা করে বলল, “দিদি, তুমি আজ চুপচাপ কেন? ট্রেন তো চলেই যাচ্ছে, তুমি এত চুপ থাকলে দম বন্ধ হয়ে যাবে।”
অদিতি তার ভাইকে হেসে জবাব দিল, “চুপ কর! এমনিই একটু ক্লান্ত লাগছে।”
তার বাবা-মা এবার সিরিয়াস গলায় বললেন, “অদিতি, তুমি ট্রেনে কারও সঙ্গে এত কথা বলছ, সেটা আমরা পছন্দ করিনি। অচেনা লোকদের সঙ্গে কথা বলা উচিত নয়। এখন তুমি বড় হচ্ছ, এসব জিনিস তোমার বোঝা উচিত।”
অদিতি কিছু বলল না। সে জানত, সত্যিই কিছু বোঝানোর দরকার নেই। তার মনের অনুভূতি শুধু তার নিজের।
অসম্পূর্ণতার মিষ্টি অনুভূতি
ট্রেন ভুবনেশ্বরের দিকে ছুটে চলল। জানালার বাইরে সূর্যাস্তের মৃদু আলো সারা প্রকৃতিকে কমলা রঙে রাঙিয়ে তুলেছিল। সেই দৃশ্য দেখে অদিতি মনে মনে বলল, “আমাদের দেখা শেষ। হয়তো এই স্মৃতিটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু যদি কখনো আবার দেখা হয়...”
এত কথা আর অনুভূতির ভিড়ে, মনের এক কোণে ছোট্ট এক আশা থেকেই গেল। অভিষেকও তার কাজের ভিড়ে ডুবে গেলেও মনের এক কোণে সেই চোখের চাহনিটুকু রেখে দিল।