মেহুল সন্ধ্যাবেলা নিজের ঘরে বসে ছিল, জানালার ধারে এক কাপ চা নিয়ে। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল, জানালার কাচে ফোঁটাগুলো ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল নিচে। আজ সারাদিন তিতাসের সাথে একবারও কথা হয়নি। আগে এমন হতো না, দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে অন্তত কয়েকবার ফোন বা মেসেজের আদান-প্রদান হতো। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে তিতাস যেন বদলে গেছে।
মেহুল ফোন হাতে নিলো। একটা মেসেজ পাঠালো—
"তিতাস, ব্যস্ত আছো? কথা বলতে পারবে?"
পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল, কোনো উত্তর নেই। দশ মিনিট, পনেরো মিনিট… ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা অজানা হতাশা ঘিরে ধরল তাকে। মন বলছিল, তিতাস ইচ্ছা করেই উত্তর দিচ্ছে না। কিন্তু কেন?
ঠিক তখনই ফোনটা কাঁপতে লাগলো। তিতাসের নাম ভেসে উঠলো স্ক্রিনে। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মেহুল কল রিসিভ করল।
"হ্যালো?"
ওপাশ থেকে একটু দেরিতে উত্তর এলো, কণ্ঠটা কেমন যেন ক্লান্ত আর দূরত্বভরা।
"হুম... বলো?"
মেহুল কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলো। এতদিনের সম্পর্কের জায়গায় এই দূরত্ব, এই আনুষ্ঠানিকতা, এই অনাগ্রহ সে মেনে নিতে পারছিল না।
"তিতাস, কী হচ্ছে আমাদের? তুমি কেমন যেন বদলে গেছো…"
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। যেন কথাটা এড়িয়ে যেতে চাইছে।
"তোমার কি আর আমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না?" মেহুলের গলা কিছুটা নরম হয়ে এলো।
"এমন কিছু না…" তিতাস বললো, কিন্তু কণ্ঠে কোনো দৃঢ়তা নেই।
"তাহলে কী? স্পষ্ট করে বলো, তিতাস! আমি জানি, তুমি এড়িয়ে যাচ্ছো। আগের মতো আর আমার জন্য সময় নেই তোমার। কী হচ্ছে আমাদের?"
এইবার তিতাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
"মেহুল, প্লিজ, একটু সময় দাও। আমি অনেক কিছু নিয়ে চিন্তায় আছি… আমার নিজেরও কিছু জটিলতা আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো।"
মেহুলের চোখে জল চলে এলো। "সব ঠিক হয়ে যাবে?" এই কথাটা সে আগেও শুনেছে, কিন্তু এখন আর বিশ্বাস হচ্ছে না।
"আমার কি এখন বোঝা হয়ে গেছি তোমার জন্য?"
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। শুধুই নীরবতা।
"তিতাস, সত্যি করে বলো, তুমি কি চাইছো আমি নিজে থেকে সরে যাই?"
এইবার তিতাস একটু থেমে বললো, "না, আমি এটা বলিনি। শুধু বলছি, কিছু সময় দাও আমাকে।"
মেহুল আর কিছু বললো না। হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখা ফোনটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখলো কোলের ওপর। সে বুঝতে পারছিল, তিতাস ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে, সম্পর্কটা যেন একটা সুতোয় ঝুলে আছে, আর সেই সুতোটা যে কোনো সময় ছিঁড়ে যেতে পারে।
কল শেষ হয়ে গেল। স্ক্রিনটা নিঃস্তব্ধ হয়ে রইলো, কিন্তু মেহুলের ভেতরে একটা ঝড় উঠলো। এই সম্পর্কটা কি সত্যি টিকে থাকবে? নাকি ধীরে ধীরে শেষের পথে এগিয়ে যাচ্ছে?
সে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেমন কাঁচ বেয়ে ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ে, তার চোখের জলও তেমনি এক ফোঁটা, দু’ফোঁটা করে গড়িয়ে পড়ছিল…